কাঠ পোড়ালে আগুন জ্বলে আবার পেট্রল বা ডিজেল এগুলো পাড়ির ইঞ্জিনে পোড়ালে তার জন্য গাড়ি চলে। তাহলে এগুলোর মধ্যে শক্তি থাকে। এ শক্তিকে রাসায়নিক শক্তি বলে। পদার্থের মধ্যে এ রাসায়নিক শক্তি কীভাবে থাকে? আবার কীভাবেই বা এ শক্তি আমাদের কাজে লাগে? টর্চের ব্যাটারি থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়ে আলো জ্বালায়। খনিজ তেল পুড়িয়ে তা থেকে তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। এ শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এ সকল কীভাবে ঘটে? এ নিয়ে অবশ্যই তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগে। বিভিন্ন দেশে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এ সবগুলোর সাথেই রসায়ন তথা রাসায়নিক বিক্রিয়া অথবা নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া জড়িত। আবার, এ বিক্রিয়াগুলোর কিছু বিরূপ প্রভাব আছে পরিবেশ ও আমাদের শরীরের উপর। এ সমস্ত বিষয়ই এ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা
রাসায়নিক শক্তির উৎস
আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে, পদার্থের মধ্যে অণু ও পরমাণু থাকে। একটি পরমাণু আরেকটি পরমাণুর সাথে আকর্ষণ শক্তির (বন্ধন শক্তি) মাধ্যমে যুক্ত থাকে। আবার, একটি অণু অন্য অণুর সাথেও আকর্ষণ শক্তির (আন্তঃআণবিক শক্তি) সাহায্যে যুক্ত থাকে। এ শক্তিগুলোকে বলা হয় রাসায়নিক শক্তি। তোমরা এই অধ্যায়ে এসব রাসায়নিক শক্তি সম্পর্কে জানবে।
বন্ধন শক্তি (Bond Energy)
বন্ধনে আবদ্ধ একটি পরমাণুর সাথে আরেকটি পরমাণু যে আকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে যুক্ত থাকে তাকে বন্ধন শক্তি বলে। সোডিয়াম ক্লোরাইডে সোডিয়াম আয়ন ও ক্লোরাইড আয়নের মধ্যে আয়নিক বন্ধন বিদ্যমান। কার্বন ডাই-অক্সাইড অণুতে কার্বন ও অক্সিজেনের মধ্যে সমযোজী বন্ধন বিদ্যমান। আবার, লোহার মধ্যে একটি আয়রন পরমাণুর সাথে অন্য আয়রন পরমাণুসমূহের মধ্যে ধাতব বন্ধন বিদ্যমান। এ সকল বন্ধনে আবদ্ধ একটি পরমাণুর সাথে আরেকটি পরমাণু যে আকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে যুক্ত থাকে তাকে বন্ধন শক্তি বলে।
আন্তঃআণবিক শক্তি
সমযোজী যৌগের অণুসমূহ একে অপরের সাথে যে আকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে যুক্ত থাকে তাকে আন্তঃআণবিক শক্তি (Intermolecular Energy) বলা হয়। যেমন: পানি একটি সমযোজী যৌগ। একটি পানির অণুর সাথে আশপাশের অন্যান্য পানির অণুসমূহ আন্তঃআণবিক আকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে যুক্ত থাকে।
অন্যদিকে সোডিয়াম ক্লোরাইডের আয়নিক যৌগে একটি সোডিয়াম আয়নের চারদিকে 6টি ক্লোরাইড আয়ন অবস্থান করে। এখানে একটি সোডিয়াম ও 6টি ক্লোরাইড আয়নের মধ্যে আকর্ষণ বিদ্যমান থাকে। আবার প্রত্যেকটি ক্লোরাইড আয়নের চারদিকে চটি সোডিয়াম আয়ন অবস্থান করে। এখানে প্রত্যেকটি ক্লোরাইড আয়ন ও 6টি সোডিয়াম আয়নের মধ্যে আকর্ষণ বিদ্যমান থাকে।
আয়নিক যৌগে আয়নসমূহের মধ্যে যে আকর্ষণ শক্তি থাকে ঐ আকর্ষণ শক্তি সমযোজী অণুর আন্তঃআণবিক শক্তির চেয়ে বেশি। এজন্য আয়নিক পদার্থের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক সমযোজী পদার্থের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক অপেক্ষা বেশি।
এজন্য আয়নিক যৌগসমূহ সাধারণত কক্ষ তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় থাকে আর সমযোজী যৌগসমূহ সাধারণত কক্ষ তাপমাত্রায় তরল বা বায়বীয় অবস্থায় থাকে। তবে অনেক সমযোজী যৌগ আছে যেগুলো কক্ষ তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় থাকে। যেমন: ন্যাপথলিন।
একই পরমাণু দিয়ে উৎপন্ন সমযোজী অণুসমূহের (যেমন— H2) আন্তঃআণবিক শক্তির চেয়ে দুইটি ভিন্ন পরমাণু দিয়ে গঠিত অণুর (যেমন HCl) আন্তঃআণবিক শক্তি বেশি হয়।
রাসায়নিক বিক্রিয়ায় শক্তির রূপান্তর
প্রত্যেক পদার্থের মধ্যে কিছু শক্তি বিদ্যমান থাকে। সাধারণত কোনো কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিক্রিয়কসমূহের শক্তি দিয়ে বিক্রিয়া ঘটাতে হয় অথবা কোনো কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটার ফলে শক্তি উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় শক্তির রূপান্তর ঘটে। বিক্রিয়া ঘটাতে যে শক্তি দিতে হয় বা বিক্রিয়া ঘটার ফলে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তার বিভিন্ন রূপ হতে পারে। যেমন— তাপশক্তি, আলোক শক্তি, বিদ্যুৎ শক্তি, শব্দ শক্তি ইত্যাদি।
শক্তি পরিমাপের একক
পূর্বে শক্তি মাপার জন্য ক্যালরি (Calorie) বা কিলো ক্যালরি (kilo Calorie) একক ব্যবহার করা হতো। 1 গ্রাম পানির তাপমাত্রা 1°C বাড়াতে যে পরিমাণ তাপশক্তি প্রদান করতে হয় তাকে এক ক্যালরি (সংক্ষেপে Cal) বলে। 1 হাজার ক্যালরিকে 1 কিলো ক্যালরি বলে। কিলো ক্যালরিকে সংক্ষেপে kcal দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
বর্তমানে সকল ধরনের শক্তির একক হিসেবে জুল (Joule) কে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। কোনো বস্তুর উপর 1 নিউটন বল প্রয়োগ করলে যদি বলের দিকে 1 মিটার সরণ ঘটে তবে তার জন্য প্রয়োজনীয় কাজকে 1 জুল বলে। একে সংক্ষেপে J দিয়ে প্রকাশ করা হয়। 1 হাজার জুলকে 1 কিলোজুল (kJ) বলে।
জুল ও ক্যালোরির সম্পর্ক হচ্ছে: 1 Cal = 4.18 J
তাপের পরিবর্তনের ভিত্তিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ
কখনো কখনো বিক্রিয়ক পদার্থে বাইরে থেকে তাপ দিয়ে বিক্রিয়া ঘটিয়ে উৎপাদে পরিণত করা হয়। আবার, কখনো কখনো বিক্রিয়ক পদার্থ নিজে নিজে উৎপাদে পরিণত হয় এবং উৎপাদে পরিণত হবার সময়ে তাপ উৎপন্ন হয়। তাপের পরিবর্তনের ভিত্তিতে রাসায়নিক বিক্রিয়া দুই ধরনের। (i) তাপোৎপাদী বিক্রিয়া (ii) তাপহারী বিক্রিয়া। তাপোৎপাদী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে ∇H এর মান ঋণাত্মক (negative) এবং তাপহারী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে ∇H এর মান ধনাত্মক (positive)।
কোনো একটি পদার্থ একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি ধারণ করে। এই শক্তিকে অভ্যন্তরীণ শক্তি বলে। যেকোনো বিক্রিয়ার বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তিকে E দ্বারা এবং উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তিকে E2 দ্বারা চিহ্নিত করা হলে ঐ বিক্রিয়ার তাপ শক্তির পরিবর্তন
|
∇H = উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি (E2) – বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি (E)
তাপোৎপাদী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি E1 উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি E2 থেকে বেশি। কাজেই এ বিক্রিয়াতে বিক্রিয়ায় ভাগ শক্তির পরিবর্তন ∇H = E2 - E1 এর মান ঋণাত্মক।
যেমন: কোনো বিক্রিয়ায় বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি 50 kJ/mol এবং উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি 20 kJ/mol হলে
∇H = (20 50) kJ/mol --30 kJ/mol
আবার, তাপহারী বিক্রিয়ায় ক্ষেত্রে বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি E1 উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি E2 থেকে কম। কাজেই এ বিক্রিয়াতে বিক্রিয়ায় তাপ শক্তির পরিবর্তন ∇H = E2 - E1 এর মান ধনাত্মক।
যেমন: কোনো বিক্রিয়ায় বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি 70 kJ/mol এবং উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি 80 kJ/mol হলে
∇H = (80 - 70 ) kJ/mol = +10kJ/mol
তাপোৎপাদী বিক্রিয়া (Exothermic Reactions )
যে বিক্রিয়ার ফলে তাপ উৎপন্ন হয় তাকে তাপোৎপাদী বিক্রিয়া বলা হয়। তাপোৎপাদী বিক্রিয়ার সমীকরণ লেখার সময় বিক্রিয়ার ডান পাশে তাপ লেখা যেতে পারে কিংবা ∇H দিয়ে প্রকাশ করা হলে ∇H এর মান ঋণাত্মক হতে হবে। তোমরা দেখেছো, কোনো কিছু রান্না করতে চুলাতে জ্বালানি হিসেবে যে গ্যাস ব্যবহার করি তা পোড়ালে তাপ উৎপন্ন হয়। আবার শুকনা চুলে পানি ঢাললে তা গরম হরে ওঠে। রান্নার গ্যাসের প্রধান উপাদান হলো মিথেন (CH4)। এ গ্যাস পোড়ালে প্রতি 1 মোল মিথেন গ্যাস বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন ডাই-অক্সাইড আর পানি উৎপন্ন হয়। সেই সাথে 890 kJ তাপও উৎপন্ন হয়।
তাপহারী বিক্রিয়া (Endothermic Reactions)
তাপ প্রদান করে যে বিক্রিয়া ঘটানো হয় সেই বিক্রিয়াকে তাপহারী বিক্রিয়া বলা হয়। তাপহারী বিক্রিয়াকে তাপশোষী বিক্রিয়াও বলা হয়। তাপহারী বিক্রিয়ার সমীকরণ লেখার সময় বিক্রিয়ার ৰাম পাশে তাপ লেখা যেতে পারে। কিন্তু ∇H দিয়ে লিখলে ∇H এর যান ধনাত্মক হতে হবে। গ্রামে শামুক বা ঝিনুকের খোলস থেকে চুন তৈরি করা হয়। অনেকগুলো শামুক বা ঝিনুকের খোলস একসাথে জড়ো করে জ্বালানি দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে সেগুলোকে উত্তপ্ত করা হয়। এতে খোলসগুলো থেকে চুন তৈরি হয়। আসলে ঝিনুক বা শামুকের খোলসগুলোতে প্রায় 98% ক্যালসিয়াম কার্বনেট (CaCO3) থাকে। আগুনের তাপে এ ক্যালসিয়াম কার্বনেট ভেঙে গিয়ে ক্যালসিয়াম অক্সাইড এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়। ক্যালসিয়াম অক্সাইড হচ্ছে চুন, সেটি পড়ে থাকে—কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসের সাথে মিশে যায়।
বন্ধন শক্তি হিসাব করে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাপের পরিবর্তনের হিসাব
রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাপের পরিবর্তন H এর মান দুইভাবে হিসাব করা হয়। যদি অভ্যন্তরীণ শক্তি ব্যবহার করি তবে উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি থেকে বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি বাদ দিয়ে ∇H এর মান হিসাব করা হয়। আর যদি বন্ধন শক্তি ব্যবহার করি তবে বিক্রিয়কসমূহের মোট বন্ধন শক্তি থেকে উৎপাদসমূহের মোট বন্ধন শক্তি বাদ দিয়ে ∇H এর মান হিসাব করা হয়। এই দুইভাবে হিসাব করলেও কোনো বিক্রিয়ার ∇H এর মান একই হয়।
কোনো যৌগের যেকোনো দুইটি পরমাণুর মধ্যকার বন্ধন ভেঙে পরমাণু দুটিকে আলাদা করতে যে শক্তি দিতে হয় তাকে বন্ধন শক্তি বলে। আবার কোনো যৌগের যেকোনো দুইটি পরমাণুর মধ্যে বন্ধন তৈরি হতে যে শক্তি নির্গত হয় তাকে বন্ধন শক্তি বলে।
রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার সময় বিক্রিয়কগুলোর মধ্যে যে বন্ধনগুলো আছে সেই বন্ধনগুলো ভেঙে যায় এবং উৎপাদগুলোর মধ্যে নতুন নতুন বন্ধন তৈরি হয়। বিক্রিয়কগুলোর বন্ধন ভাঙার জন্য শক্তি দিতে হয় এবং উৎপাদগুলোর বন্ধন তৈরি হতে শক্তি নির্গত হয়।
যেকোনো বিক্রিয়ায় বিক্রিয়কগুলোর মোট বন্ধন শক্তিকে B1 দিয়ে এবং উৎপাদসমূহের মোট বন্ধন শক্তিকে B2 দিয়ে চিহ্নিত করা হলে ঐ বিক্রিয়ার তাপ শক্তির পরিবর্তন:
∇H = বিক্রিয়কগুলোর মোট বন্ধন শক্তি B1 – উৎপাদগুলোর মোট বন্ধন শক্তি B2 = (বিক্রিয়কগুলোর বন্ধন ভাঙার জন্য দেওয়া মোট শক্তি B1 ) . (উৎপাদনগুলোর বন্ধন তৈরি হওয়ার জন্য নির্গত হওয়া মোট শক্তি B2 ) |
তাপ উৎপাদী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে B1 এর মান B2 থেকে কম এজন্য তাপ উৎপাদী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে ∇H এর মান ঋণাত্মক। অন্যদিকে তাপহারী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে B1 এর মান B2 থেকে বেশি এজন্য ভাপহারী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে ∇H এর মান ধনাত্মক।
রাসায়নিক শক্তিকে বিভিন্ন শক্তিতে রূপান্তরিত করে আমরা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতে পারি।
রাসায়নিক শক্তিকে অন্য প্রকারের শক্তিতে রূপান্তর
রাসায়নিক শক্তি তাপ, আলো, বিদ্যুৎ, শব্দ বা যান্ত্রিক ইত্যাদি যেকোনো শক্তিতে রূপান্তর হতে পারে । নিচে কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো।
জ্বালানি পোড়ানো কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, কাঠ ইত্যাদি পোড়ালে তাপ ও আলোক শক্তি পাই। এ শক্তি মূলত এ পদার্থগুলোর মধ্যে বিদ্যমান রাসায়নিক শক্তি থেকে পাওয়া যায়। দহন বা পোড়ানো হলো কোনো পদার্থকে বায়ুর অক্সিজেন-এর সাথে বিক্রিয়া করানো। প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান উপাদান হলো মিথেন (CH.)। মিথেনে যখন দহন ঘটে অর্থাৎ মিথেনকে যখন অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া ঘটানো হয় তখন কার্বন ডাই-অক্সাইড, জলীয় বাষ্প, তাপ এবং আলো সৃষ্টি হয়।
আতশ-বাজি
তোমরা বড় অনুষ্ঠানের দিনে আকাশে যে আতশবাজি দেখো সেখান থেকে আলো, শব্দ ও যান্ত্রিক শক্তি (গতিশক্তি) পাওয়া যায়। আতশবাজির মাঝে যে রাসায়নিক পদার্থগুলো থাকে তাদের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে আর রাসায়নিক শক্তি থেকে আলো, শব্দ ও যান্ত্রিক শক্তি পাওয়া যায়।
ড্রাই সেল
তোমরা সবাই ব্যাটারি দেখেছো টর্চলাইট বা টেলিভিশনের রিমোটে যে পেনসিল ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়, সেগুলো আসলে ড্রাই সেল (ব্যাটারি বা ড্রাই সেল সম্বন্ধে পরবর্তীতে আমরা আরও জানতে পারব)। ড্রাই সেলের মধ্যে যে সকল রাসায়নিক পদার্থ থাকে তাদের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে রাসায়নিক শক্তি রূপান্তরিত হয়ে বিদ্যুৎ শক্তিতে পরিণত হয়।
ডেনিয়েল সেল
তোমরা বাসে, ট্রাকে যে ব্যাটারি দেখে থাকো তা মূলত ডেনিয়েল সেল। জিংক সালফেট লবণের দ্রবণের মধ্যে জিংক ধাতুর দণ্ড এবং কপার সালফেট লবণের দ্রবণের মধ্যে কপার ধাতুর দণ্ড ব্যবহার করে ডেনিয়েল সেল তৈরি করা হয়। এতে নিচের বিক্রিয়া ঘটে:
Zn(s) + CuSO4 (aq) ZnSO4 (aq) + Cu(s)
এ বিক্রিয়ার মাধ্যমে রাসায়নিক শক্তি বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
রাসায়নিক শক্তি এবং রাসায়নিক শক্তি থেকে পাওয়া বিভিন্ন শক্তির ব্যবহার
পদার্থের অণু-পরমাণুর মধ্যে রাসায়নিক শক্তি সঞ্চিত থাকে। একটি পদার্থ যখন আরেকটি পদার্থের সাথে বিক্রিয়া করে তখন রাসায়নিক শক্তি পাওয়া যায়। এ শক্তিকে পরবর্তীকালে বিভিন্ন শক্তিতে রূপান্তর করে আমাদের বিভিন্ন কাজে লাগাই। পৃথিবীতে সকল প্রকার শক্তির মাঝে রাসায়নিক শক্তি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
রান্নার কাজে আমরা জ্বালানি হিসেবে কাঠ বা প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করি। কাঠ বা প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ালে এদের ভিতরের রাসায়নিক শক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। কাঠ পোড়ালে যে তাপ পাওয়া যায় সে তাপ ব্যবহার করে ইটের ভাটায় ইট এবং মাটির বিভিন্ন পাত্র তৈরি করা হয়। লোহা, ইস্পাত বা সিরামিকস প্রভৃতি কারখানায় প্রচুর তাপের প্রয়োজন হয়। কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস ইত্যাদি খনিজ জ্বালানি তাপ ইঞ্জিনে ব্যবহার করা হয়। এ জ্বালানি ইঞ্জিনের দহন চেম্বারে পুড়িয়ে যে তাপশক্তি উৎপন্ন হয় তাকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে মোটর গাড়ি, জাহাজ, বিমান, রেলগাড়ি ইত্যাদি চালানো হয়।
রাসায়নিক শক্তির কথা বলতে গেলে প্রথমেই যেটি সামনে চলে আসে সেটি হলো সালোক সংশ্লেষণ। উদ্ভিদের সবুজ অংশে ক্লোরোফিল থাকে, এই ক্লোরোফিলের সহায়তায় এবং সূর্যালোক ব্যবহার করে উদ্ভিদে মাটি থেকে মূল দিয়ে শোষিত পানি ও বায়ু থেকে শোষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড বিক্রিয়া করে গ্লুকোজ (C6H12O6) নামক শর্করা তৈরি করে, সেই সাথে অক্সিজেনও উৎপন্ন হয়। এ অক্সিজেন উদ্ভিদ থেকে বের হয়ে যায়। এ বিক্রিয়াটিকেই আমরা সালোক সংশ্লেষণ বলি। তবে সালোক সংশ্লেষণ ঘটাতে উদ্ভিদ যে সূর্যালোক ব্যবহার করে তা রাসায়নিক শক্তি হিসেবে শর্করার মধ্যে থেকে যায়।
এছাড়া উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহে প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় পদার্থ তৈরি হয়। এগুলোতেও রাসায়নিক শক্তি মজুদ থাকে। আবার, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকুল এগুলো খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহকে রাসায়নিক যন্ত্র বলা যেতে পারে। উদ্ভিদ এ শর্করা, প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় খাদ্য থেকে রাসায়নিক শক্তি পায়। এ শক্তি তাপশক্তি বা অন্যান্য প্রকার শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এ শক্তি ব্যবহার করে উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল বিভিন্ন জৈবিক কার্যকলাপ করে। কাজেই বুঝতেই পারছো রাসায়নিক শক্তি ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব অসম্ভব।
রাসায়নিক শক্তির যথাযথ ব্যবহার
পেট্রোলিয়াম, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস এগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানি বলে। এসব জ্বালানির মাঝে রাসায়নিক শক্তি জমা থাকে। এসব জ্বালানির দহন ঘটিয়ে বা জ্বালানিকে অক্সিজেনে পোড়ালে জ্বালানির মধ্যে বিদ্যমান রাসায়নিক শক্তি থেকে আমরা তাপশক্তি পাই। এই তাপশক্তি ব্যবহার করে আমরা রান্না, গাড়ি চালানো, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নানা ধরনের কাজ করছি।
এসব জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ালে একদিকে যেমন আমরা তাপশক্তি পাই, অন্যদিকে এই জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ালে পরিবেশের ক্ষতি হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ালে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়। প্রতিবছর জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে 21.3 বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হচ্ছে। কার্বন ডাই- অক্সাইড গ্রিনহাউজ গ্যাস অর্থাৎ এটি তাপ ধারণ করে। যার ফলে বিশ্ব ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠছে। আবার কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বৃষ্টির পানির সাথে বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড (H2CO3) তৈরি করছে, যা বৃষ্টির পানির সাথে মাটিতে পড়ছে। একে আমরা এসিড বৃষ্টি বলি। এসিড বৃষ্টি পরিবেশের অনেক ক্ষতি করে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট এ সকল কারণে এক সময় পৃথিবীতে জীবের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। তাই জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমিত ব্যবহার করা উচিত। কোনোভাবেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা উচিত নয়। পৃথিবীতে যে পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি আছে তার চেয়ে বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি তৈরি হবে না। জীবাশ্ম জ্বালানি অতিরিক্ত ব্যবহার করলে এক সময় জীবাশ্ম জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে। জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার না করলে পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের উপর চাপ কমবে এবং পরিবেশের জন্যও কল্যাণকর হবে।
জ্বালানির বিশুদ্ধতার গুরুত্ব
রাসায়নিক শক্তির আধার হিসেবে আমরা নানা ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করি। বিশেষ করে কাঠ, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে যাচ্ছি। এ সমস্ত জ্বালানি বিশুদ্ধ হওয়া একান্ত জরুরি। স্বল্প বায়ুর উপস্থিতিতে এসব জ্বালানি পোড়ালে কার্বন ডাই-অক্সাইডের সাথে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়, যেটি বিষাক্ত একটি গ্যাস। এগুলো আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্রকৃতিতে যে জ্বালানি পাওয়া যায়, সেগুলো মূলত অবিশুদ্ধ থাকে। এর সাথে নাইট্রোজেন, সালফার, ফসফরাস প্রভৃতি মৌলের বিভিন্ন যৌগ মিশ্রিত থাকে। সেজন্য বাজারে এসব জ্বালানি ছাড়ার আগে যথেষ্ট পরিমাণে বিশুদ্ধ করে নেওয়া দরকার। বিশুদ্ধ না করে সে জ্বালানি পোড়ালে কার্বন ডাই- অক্সাইড গ্যাসের সাথে এসব মৌলের অক্সাইডও বাতাসে চলে আসে। এসব অক্সাইড বৃষ্টির পানির সাথে মিশে এসিড তৈরি করে। ফলে তখন যে বৃষ্টি হয় তার সাথে এ এসিডগুলো যথেষ্ট পরিমাণে মিশ্রিত থাকে। এ বৃষ্টিকে এসিড বৃষ্টি বলে।
এ এসিড বৃষ্টি পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। গাছপালা মরে যায়। জলাশয়ের পানি অম্লযুক্ত হয়ে যায়। ফলে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ায় কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড ও অব্যবহৃত জ্বালানি (যেমন-মিথেন) থাকে। সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে এগুলো নানা রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাসের ধোঁয়া সৃষ্টি করে। এদেরকে 'ফটোকেমিক্যাল ধোঁয়া' (photochemical smog) বলে। ফটোকেমিক্যাল ধোঁয়ার বিভিন্ন উপাদান বায়ুমণ্ডলের ওজোন (O3) স্তরের ক্ষয়সাধন করে। ওজোন সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে। কাজেই এই স্তরের ক্ষয়সাধন হলে পৃথিবীর মানুষ বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
রাসায়নিক শক্তি ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব
আমরা শক্তি পাবার জন্য জ্বালানি পোড়াচ্ছি। মূলত আমরা জ্বালানির মাধ্যমে রাসায়নিক শক্তিকে ব্যবহার করছি। যদিও বর্তমান বিশ্বে সৌরশক্তি, নিউক্লিয়ার শক্তি, বাতাসের শক্তি, স্রোতের শক্তিকেও কাজে লাগানো হচ্ছে, তবু জীবাশ্ম জ্বালানিই আমাদের প্রয়োজনীয় শক্তির সিংহভাগ জোগান দেয়। আমরা আগেই বলেছি, প্রতিবছর জ্বালানি পুড়িয়ে 21.3 বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করা হচ্ছে। গাছ সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। এছাড়া আরও কিছু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এর অর্ধেকটা ব্যবহার হয়। বাকি অর্ধেক পৃথিবীতে থেকে যায়। কার্বন ডাই-অক্সাইড ভারী গ্যাস বলে তা বায়ুমণ্ডলের নিচের অংশেই থেকে যায়। কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুর অন্য উপাদানের সাথে বিক্রিয়াও করে না। কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রচুর পরিমাণে তাপশক্তি ধারণ করতে পারে। এতে করে পৃথিবীর তাপমাত্রা দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। একে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন (global warming) বলে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবার কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সেটি সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। যে কারণে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের বিশাল অংশ পানির নিচে ডুবে যাবে। কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়াও আরও কিছু গ্যাস আছে যেগুলো পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির এ ঘটনাকে 'গ্রিনহাউস প্রভাব বলে' (greenhouse effect)। আর এ সকল গ্যাসকে গ্রিনহাউস গ্যাস বলে। কার্বন ডাইঅক্সাইডের ভূমিকা এক্ষেত্রে অন্যান্য গ্যাসের চেয়ে অনেক বেশি। তোমরা ইতোমধ্যে জেনেছো জ্বালানি পোড়ানোর ফলে প্রাপ্ত গ্যাসগুলো এসিড বৃষ্টির কারণ। এছাড়া তোমরা জেনেছো যে জ্বালানি পোড়ানোর ফলে প্রাপ্ত গ্যাসগুলো ফটোকেমিক্যাল ধোঁয়ার সৃষ্টি করছে। এসব গ্যাস বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের সাথে বিক্রিয়া করে ওজোন স্তরের পুরুত্ব কমিয়ে দিচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর সূর্যের আলোর ছাঁকনি হিসেবে কাজ করে। সূর্যের আলোতে অতিবেগুনি রশ্মি (ultra violet ray) থাকে, যা আমাদের ত্বকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে। ওজোন স্তর এ অতিবেগুনি রশ্মিকে পৃথিবীতে আসতে বাধা প্রদান করে।
ইথানলকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার
ইথানল-এর অপর নাম ইথাইল অ্যালকোহল। এর রাসায়নিক সংকেত CH3-CH2-OH । জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রল প্রভৃতির মতো ইথানলকে পোড়ালেও তাপ উৎপন্ন হয়। তাই জীবাশ্ম জ্বালানির মতো ইথানলকেও তাপ ইঞ্জিনে ব্যবহার করে কলকারখানা, গাড়ি, বিমান, জাহাজ প্রভৃতি চালানো যেতে পারে। উত্তর আমেরিকাসহ অনেক দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির সাথে ইথানলকে মিশিয়ে তাপ ইঞ্জিনে ব্যবহার করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সব গাড়িতে পেট্রলের সাথে শতকরা 10 ভাগ ইথানল মিশিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই আমরা যত ইথানলকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করব ততই জীবাশ্ম জ্বালানির উপর চাপ কমবে।
তড়িৎ রাসায়নিক কোষ (Electrochemical cell)
জ্বালানি পুড়িয়ে রাসায়নিক শক্তিকে তাপশক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। এই তাপশক্তিকে আবার বিদ্যুৎ শক্তিতে পরিণত করা যায়। এবার আমরা জানব কীভাবে রাসায়নিক শক্তিকে সরাসরি বিদ্যুৎ শক্তিতে এবং বিদ্যুৎ শক্তিকে ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো যায়। যে যন্ত্রের সাহায্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে রাসায়নিক শক্তিকে সরাসরি বিদ্যুৎ শক্তিতে অথবা বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো হয় তাকে তড়িৎ রাসায়নিক কোষ বলে। তড়িৎ রাসায়নিক কোষে একই বা দুইটি ভিন্ন তড়িৎ বিশ্লেষ্যের দ্রবণে দুইটি ধাতব দণ্ড বা গ্রাফাইট দণ্ডই আংশিক ডুবানো থাকে। অতঃপর দণ্ড দুটিকে একটি ধাতব তার দিয়ে সরাসরি বা ব্যাটারির মাধ্যমে সংযোগ দেওয়া হয়। কোষের মধ্যে ধাতব দণ্ড বা গ্রাফাইট দণ্ডকে তড়িৎদ্বার বা ইলেকট্রোড (Electrode) বলা হয়।
তড়িৎ রাসায়নিক কোষ দুই প্রকার।
(i) তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ (Electrolytic Cell): যে কোষে বাইরের কোনো উৎস থেকে তড়িৎ প্রবাহিত করে কোষের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো যায় সেই কোষকে তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ বলে।
(ii) গ্যালভানিক কোষ (Gavlanic Cell): যে কোষে রাসায়নিক পদার্থসমূহ বিক্রিয়া করে বিদ্যুৎ শক্তি
উৎপাদন করে সেই কোষকে গ্যালভানিক কোষ বলা হয়।
বিদ্যুৎ পরিবাহী: (Conductor)
যে সকল পদার্থ বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে তাদেরকে বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থ বলে। যেমন— ধাতু, গ্রাফাইট, গলিত লবণ, লবণের দ্রবণ, এসিড ও ক্ষারের দ্রবণ প্রভৃতি বিদ্যুৎ পরিবাহীর উদাহরণ। বিদ্যুৎ পরিবহনের কৌশলের উপর নির্ভর করে বিদ্যুৎ পরিবাহী দুই প্রকার হতে পারে। যথা: (i) ইলেকট্রনীয় পরিবাহী এবং (ii) তড়িৎ বিশ্লেষ্য।
ইলেকট্রনীয় পরিবাহী (Electronic Conductor)
যেসব পদার্থের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন মাধ্যমে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হয় সেসব পরিবাহীকে ইলেকট্রনীয় পরিবাহী বলে। তোমরা দেখেছো ধাতুর মধ্যে ধাতব বন্ধন বিদ্যমান। এখানে প্রচুর পরিমাণে মুক্ত ইলেকট্রন থাকে। গ্রাফাইটেও মুক্ত ইলেকট্রন থাকে। এ সকল পদার্থের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন মাধ্যমে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হয়। সকল পরিবাহীকে ইলেকট্রনীয় পরিবাহী বলে। যেমন- লোহা (Fe), কপার (Cu), নিকেল (Ni), গ্রাফাইট ইত্যাদি ইলেকট্রনীয় পরিবাহী।
তড়িৎ বিশ্লেষ্য (Electrolyte)
যেসব পদার্থ কঠিন অবস্থায় বিদ্যুৎ পরিবহন করে না কিন্তু গলিত বা দ্রবীভূত অবস্থায় বিদ্যুৎ পরিবহন করে এবং বিদ্যুৎ পরিবহনের সাথে সাথে ঐ পদার্থের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায় তাদেরকে তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ বলে। তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ গলিত বা দ্রবীভূত অবস্থায় আয়নিত অবস্থায় থাকে। এই আয়নের মাধ্যমে তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ বিদ্যুৎ পরিবহন করে। আয়নিক যৌগ এবং কিছু পোলার সমযোজী যৌগ গলিত বা দ্রবীভূত অবস্থায় তড়িৎ বিশ্লেষ্য পরিবাহী হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl), কপার সালফেট (CuSO4), সালফিউরিক এসিড (H2SO4), পানি (H2O), ইথানয়িক এসিড (CH3COOH) ইত্যাদি গলিত বা দ্রবীভূত অবস্থায় বিদ্যুৎ পরিবহন করে।
তড়িৎ বিশ্লেষ্য আবার দুই প্রকার
(i) তীব্র তড়িৎ বিশ্লেষ্য (Strong Electrolyte): যে সকল তড়িৎ বিশ্লেষ্য দ্রবণে বা গলিত অবস্থায় সম্পূর্ণরূপে আয়নিত অবস্থায় থাকে তাদেরকে তীব্র তড়িৎ বিশ্লেষ্য বলে। যেমন—সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl), কপার সালফেট (CuSO4), সালফিউরিক এসিড (H2SO4) ইত্যাদি।
(ii) মৃদু তড়িৎ বিশ্লেষ্য (Weak Electrolyte): যে সকল তড়িৎ বিশ্লেষ্য দ্রবণে খুব অল্প পরিমাণে আয়নিত অবস্থায় থাকে তাদেরকে মৃদু তড়িৎ বিশ্লেষ্য বলে। যেমন: পানি (H2O), ইথানয়িক এসিড (CH3COOH) ইত্যাদি।
তড়িৎদ্বার (Electrode)
তড়িৎ রাসায়নিক কোষে বিগলিত বা দ্রবীভূত তড়িৎ বিশ্লেষ্যের মধ্যে যে দুটি ইলেকট্রনীয় পরিবাহী অর্থাৎ ধাতব দণ্ড বা গ্রাফাইট দণ্ড প্রবেশ করানো হয় তাদেরকে তড়িৎদ্বার বলা হয়। তড়িৎ রাসায়নিক কোষে একটি তড়িৎদ্বারে কোনো পরমাণু বা আয়ন ইলেকট্রন ত্যাগ করে। অর্থাৎ এ তড়িৎদ্বারে জারণ বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। অপর তড়িৎদ্বার থেকে ধনাত্মক আয়ন ইলেকট্রন গ্রহণ করে। অর্থাৎ এ তড়িৎদ্বারে বিজারণ বিক্রিয়া সংঘটিত হয় এবং সম্পূর্ণ কোষের মধ্যে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। যে তড়িৎদ্বারে জারণ বিক্রিয়া ঘটে তাকে অ্যানোড তড়িৎদ্বার আর যে তড়িৎদ্বারে বিজারণ বিক্রিয়া ঘটে তাকে ক্যাথোড তড়িৎদ্বার বলে।
তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ, তড়িৎ বিশ্লেষণ ও তড়িৎ বিশ্লেষণের কৌশল
তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষে (Electrolytic cell) বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো হয়। গলিত বা দ্রবীভূত অবস্থায় তড়িৎ বিশ্লেষ্যের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ পরিবহনের সময় উক্ত তড়িৎ বিশ্লেষ্যের যে রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয় তাকে তড়িৎ বিশ্লেষণ (Electrolysis) বলা হয়।
যেমন—গলিত সোডিয়াম ক্লোরাইডের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করলে অ্যানোডে ক্লোরিন গ্যাস আর ক্যাথোডে সোডিয়াম ধাতু উৎপন্ন হওয়াই সোডিয়াম ক্লোরাইডের তড়িৎ বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া:
2NaCl(1) 2Na (s) + Cl2 (g)
গলিত সোডিয়াম ক্লোরাইডের তড়িৎ বিশ্লেষণের কৌশল
একটি কাচ বা চিনামাটির পাত্রে গলিত সোডিয়াম ক্লোরাইড নেওয়া হয়। গলিত সোডিয়াম ক্লোরাইডের মধ্যে সোডিয়াম আয়ন (Na+) ও ক্লোরাইড (Cl-) আয়ন থাকে। সোডিয়াম আয়ন ও ক্লোরাইড আয়ন চলাচল ( migrate) করতে পারে। গলিত সোডিয়াম ক্লোরাইডের মধ্যে দুটি ধাতব দণ্ড বা গ্রাফাইট দণ্ড প্রবেশ করানো হয়। এ দণ্ড দুটির একটিকে ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্তে এবং অপরটিকে ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত করলে ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত ধনাত্মক তড়িৎদ্বার বা অ্যানোড ঋণাত্মক আধান যুক্ত Cl- আরনকে আকর্ষণ করবে, অন্যদিকে ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত ঋণাত্মক তড়িৎদ্বার বা ক্যাথোড ধনাত্মক আধানযুক্ত Na+ আয়নকে আকর্ষণ করবে। Cl- আয়ন অ্যানোডে ইলেকট্রন ত্যাগ করে ক্লোরিন গ্যাসে পরিণত হয়।
লিটমাস পেপারের সাহায্যে অানোডের ক্লোরিন গ্যাস শনাক্তকরণ
গলিত NaCl এর তড়িৎ বিশ্লেষণের সময় অ্যানোডে উৎপন্ন গ্যাস একটি টেস্টটিউবে সংগ্রহ করে তার মুখে ভিজা নীল লিটমাস পেপার ধরলে লিটমাস পেপারের বর্ণ লাল বর্ণে পরিণত হবে এবং ক্লোরিন গ্যাসের উপস্থিতি প্রমাণ করবে।
কোনো দ্রবণে একের অধিক প্রকারের ক্যাটায়ন ও অ্যানায়ন উপস্থিত থাকলে ক্যাথোডে কোন ক্যাটায়ন আগে গিয়ে চার্জযুক্ত হবে বা অ্যানোডে কোন অ্যানায়ন আগে গিয়ে চার্জযুক্ত হবে তা তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন:
(1) ক্যাটায়ন বা অ্যানায়নের চার্জযুক্ত হওয়ার প্রবণতা
তড়িৎ বিশ্লেষণের সময় দ্রবণে একের অধিক প্রকার ক্যাটায়ন থাকলে ক্যাটায়নসমূহের মধ্যে কোনটি আগে ক্যাথোডে পিয়ে ইলেকট্রন গ্রহণ করে চার্জযুক্ত হবে, কোনটি পরে ইলেকট্রন গ্রহণ করে চার্জযুক্ত হবে তার উপর ভিত্তি করে ক্যাটায়নসমূহকে
একটি সারণিতে সাজানো হয়েছে। এই সারণিকে ধাতুর সক্রিয়তা সিরিজ বা ধাতুর তড়িৎ রাসায়নিক সারি বলা হয়। এই সারির যেকোনো দুটি মৌলের মধ্যে যে ধাতুটি উপরে অবস্থিত সেই ধাতুটি অধিক সক্রির অর্থাৎ সেই ধাতুটি দ্রুত বিক্রিয়া করে। আবার, এই সারির যেকোনো দুটি মৌলের আয়নের মধ্যে যে আয়নটি নিচে অবস্থিত সেটি আগে ইলেকট্রন গ্রহণ করে আগে চার্জযুক্ত হবে অর্থাৎ আগে বিজারিত হবে। যেমন— Na+ এবং H+ এর মধ্যে H+ সারির নিচে অবস্থিত কাজেই H+ আগে ইলেকট্রন গ্রহণ করে চার্জযুক্ত হবে অর্থাৎ আগে বিজারিত হবে। আবার, Zn 2+ এবং Fe2+ এর মধ্যে Fe2+ তড়িৎ রাসায়নিক সারির নিচে অবস্থিত। কাজেই Fe2+ আগে ইলেকট্রন গ্রহণ করে আগে চার্জযুক্ত হবে অর্থাৎ আগে বিষ্ফারিত হবে।
তড়িৎ বিশ্লেষণের সময় একের অধিক অ্যানায়ন থাকলে অ্যানোডের অ্যানায়নসমূহের মধ্যে কোনটি আগে ইলেকট্রন ত্যাগ করে আগে চার্জমুক্ত হবে, কোনটি পরে ইলেকট্রন ত্যাগ করে চার্জমুক্ত হবে তার উপর ভিত্তি করে অ্যানায়নসমূহকেও আরও একটি সারণিতে সাজানো হয়েছে। এই সারণিকে অ্যানায়নের তড়িৎ রাসায়নিক সারি বলা হয়। এই সারির যেকোনো দুটি আয়নের মধ্যে যে আয়নটি নিচে অবস্থিত সেটি আগে ইলেকট্রন ত্যাগ করে আগে চার্জমুক্ত হবে অর্থাৎ আগে জারিত হবে। যেমন: SO42- এবং Cl এর মধ্যে Cl- সারির নিচে অবস্থিত। কাজেই cl- আগে ইলেকট্রন ত্যাগ করে চার্জমুক্ত হবে অর্থাৎ আগে জারিত হবে। আবার, cl- এবং OH এর মধ্যে OH- তড়িৎ রাসায়নিক সারির নিচে অবস্থিত। কাজেই OH— আগে ইলেকট্রন ত্যাগ করে চার্জমুক্ত হবে অর্থাৎ আগে জারিত হবে।
(ii) ক্যাটায়ন ও অ্যানায়নের ঘনমাত্রার প্রভাব
দ্রবণে একের অধিক ক্যাটায়ন বা অ্যানায়ন থাকলে চার্জমুক্ত হওয়ার প্রবণতার চেয়ে ঘনমাত্রার প্রভাব অনেক বেশি কার্যকর হয়। যেমন— কক্ষ তাপমাত্রায় 0.1 মোলার NaCl এর জলীয় দ্রবণে অ্যানায়ন Cl- আয়নের ঘনমাত্রা হবে 0.1 মোলার। অন্যদিকে, পানির বিয়োজনে অ্যানায়ন OH- আয়নের ঘনমাত্রা হবে 107 মোলার। অর্থাৎ Cl- আয়নের ঘনমাত্রা OH- আয়নের ঘনমাত্রার চেয়ে 106 গুণ বেশি। চার্জমুক্ত হবার প্রবণতার সারিতে OH- আয়নের অবস্থান C1- আয়নের নিচে হওয়ায় OH- আয়নের আগে চার্জমুক্ত হবার প্রবণতা বেশি। কিন্তু Cl- আয়নের ঘনমাত্রা বেশি হওয়ায় cl- আয়ন আগে চার্জমুক্ত হয়।
(iii) তড়িৎ দ্বারের প্রকৃতি
তড়িৎবিশ্লেষ্য কোষে তড়িৎদ্বারের প্রকৃতি অনেক সময় চার্জমুক্ত হওয়ার জন্য উপরের দুইটি নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটায়। তোমরা দেখেছো NaCl এর জলীয় দ্রবণে দুই ধরনের ক্যাটায়ন থাকে। একটি Na+ আয়ন, অপরটি H+ আয়ন। যদি প্লাটিনাম তড়িৎদ্বার ব্যবহার করা হয় তবে চার্জমুক্ত হবার প্রবণতা অনুযায়ী ক্যাথোডে H+ চার্জমুক্ত হয়ে H2 গ্যাস উৎপন্ন করে। আর যদি পারদকে ক্যাথোড রূপে ব্যবহার করা হয় তবে Na+ আয়ন আগে চার্জমুক্ত হয়।
বিশুদ্ধ পানির তড়িৎ বিশ্লেষণ
বিশুদ্ধ পানিকে তড়িৎ বিশ্লেষণ করতে তড়িৎ বিশ্লেষণ কোষে নিষ্ক্রিয় ধাতুর অ্যানোড ও ক্যাথোড ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে প্লাটিনাম ধাতুর পাত অ্যানোড ও ক্যাথোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পানি সামান্য পরিমাণে নিম্নরূপে আয়নিত অবস্থায় থাকে:
4H20 4H+ + 40H-
পানির বিয়োজন বৃদ্ধি করার জন্য পানিতে কয়েক ফোঁটা সালফিউরিক এসিড যোগ করা হয়।
আর ক্যাথোড হাইড্রোজেন আয়নকে (H+) আকর্ষণ করে। তড়িৎদ্বার দুইটিতে নিম্নরূপ বিক্রিয়া ঘটে।
ক্যাথোড তড়িৎদ্বারে বিক্রিয়া: 4H+ + 4e- 2H2 (বিজারণ ক্রিয়া)
অ্যানোড তড়িৎদ্বারে বিক্রিয়া: 40H- 02 + 2H2O + 4e (জারণ ক্রিয়া)
অর্থাৎ ক্যাথোডে হাইড্রোজেন গ্যাস আর অ্যানোডে অক্সিজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। তোমরা হয়তো ভাবছো এখানে কয়েক ফোঁটা সালফিউরিক এসিড বা কয়েক দানা NaCl কেন ব্যবহার করা হলো? তোমরা জানো একটি পূর্ণ বর্তনী তৈরি না হলে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় না। অ্যানোড, ক্যাথোড বা ব্যাটারির মধ্যে ইলেকট্রনের মাধ্যমে বিদুৎ প্রবাহিত হয়। কিন্তু তরলের মধ্য দিয়ে আয়নের মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। পানি খুবই অল্প পরিমাণে আয়নিত হয়। তাই বিশুদ্ধ পানি বিদ্যুৎ অপরিবাহীর মতো আচরণ করে। বিদ্যুৎ পরিবাহিতা বাড়াতে তাই সামান্য পরিমাণ সালফিউরিক এসিড ব্যবহার করা হয়।
তড়িৎ বিশ্লেষণের ব্যবহার
বর্তমানে সমস্ত পৃথিবীতে শিল্পকারখানার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। আর শিল্পজগতে তড়িৎ বিশ্লেষেণের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না। অনেক মূল্যবান যৌগের উৎপাদনে, আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশনে, অবিশুদ্ধ ধাতুকে বিশুদ্ধ ধাতুতে পরিণত করতে, যে সকল ধাতু সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তাদের ক্ষয় থেকে রক্ষা করতে, লোহার উপর মরিচা পড়া ঠেকাতে, এক ধাতুর উপর অন্য ধাতুর প্রলেপ দিতে তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় আর তড়িৎ বিশ্লেষণ করতে তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ ব্যবহার করা হয়। নিচে তড়িৎ বিশ্লেষণের কিছু ব্যবহার দেখানো হলো :
ধাতু নিষ্কাশন: ক্ষার ধাতু, মৃৎক্ষার ধাতু, অ্যালুমিনিয়াম ধাতু প্রভৃতি সক্রিয় ধাতুসমূহ তড়িৎ বিশ্লেষ পদ্ধতিতে নিকাশন করা হয়। সাধারণত এ সকল ধাতুর যৌগের ভরলে অথবা দ্রবণে তড়িত্রার ব্যবহার করে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করলে ক্যাথোডে ধাতু উৎপন্ন হয়। যেমন— গলিত সোডিয়াম
ক্লোরাইডের তড়িৎ বিশ্লেষণের সময় ক্যাথোডে ধাতব সোডিয়াম পাওয়া যায় এবং অ্যানোডে ক্লোরিন গ্যাস (Cl2) পাওয়া যায়।
গলিত বিশুদ্ধ অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড বা অ্যালুমিনা (Al2O3) এর তড়িৎ বিশ্লেষণ করলে ক্যাথোডে অ্যালুমিনিয়াম ধাতু ও অ্যানোডে অক্সিজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়।
ধাতু বিশুদ্ধকরণ: আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশনের পর প্রাপ্ত ধাতুতে যথেষ্ট পরিমাণে ভেজাল দ্ৰব্য মিশ্রিত থাকে। এ সকল ধাতুকে বিশুদ্ধ করতে তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর। কপার, জিংক, লেড, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি ধাতুকে বিশুদ্ধকরণের জন্য তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যে ভেজাল মিশ্রিত ধাতু থেকে ভেজাল অপসারণ করে আমরা বিশুদ্ধ ধাতু তৈরি করতে চাই সেই ভেজাল মিশ্রিত ধাতুর দণ্ডকে ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত করা হয়। যে ধাতুকে বিশুদ্ধ করতে চাই ঐ ধাতুর একটি বিশুদ্ধ দণ্ড ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত করা হয়। এরপর তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে ভেজাল মিশ্রিত অবিশুদ্ধ ধাতুর দণ্ড থেকে ধাতব আয়ন দ্রবণে চলে যায় এবং দ্রবণ থেকে ঐ ধাতব আয়ন বিশুদ্ধ ধাতব দণ্ডে লেগে যায়, ফলে ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত বিশুদ্ধ ধাতব দণ্ড মোটা হতে থাকে। তড়িৎ বিশ্লেষণ চলাকালে একদিকে ভেজাল মিশ্রিত অবিশুদ্ধ ধাতব দণ্ড ক্ষয় হতে থাকে, অন্যদিকে বিশুদ্ধ ধাতব দণ্ড মোটা হতে থাকে।
ইলেকট্রোপ্লেটিং বা তড়িৎ প্রলেপন: তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি ধাতুর উপর অন্য একটি ধাতুর প্রলেপ দেওয়াকে ইলেকট্রোপ্লেটিং বলে। ধাতুর উজ্জ্বলতা সৃষ্টির জন্য অথবা ধাতুর ক্ষয়রোধ করতে ইলেকট্রোপ্লেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। কোনো ধাতুর উজ্জ্বলতা সৃষ্টির জন্য অন্য একটি উজ্জ্বল ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হয়। কারণ কম সক্রিয় ধাতু বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে না। কোনো ধাতুর ক্ষয়রোধ করতে ঐ ধাতুর উপর অপেক্ষাকৃত কম সক্রিয় অন্য ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হয়। ইলেকট্রোপ্লেটিং এর জন্য সাধারণত নিকেল, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি ধাতু ব্যবহার করা হয়। লোহা জলীয় বাষ্প এবং বায়ুর সংস্পর্শে এলে মরিচা ধরে এবং ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। লোহার উপর নিকেল, ক্রোমিয়াম ও সিলভার ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হয়। ফলে লোহা বাতাস ও জলীয় বাষ্পের সংস্পর্শে আসতে পারে না এবং মরিচাও পড়ে না। লোহার তৈরি কোনো জিনিসের উপর প্রলেপ দেওয়ার কৌশল নিচে আলোচনা করা হলো।
লোহার তৈরি কোনো জিনিস যেমন, চামচ এর উপর সিলভারের প্রলেপ দিতে AgNO3 দ্রবণ একটি কাচপাত্রের মধ্যে নেওয়া হয়। যে জিনিসের উপর প্রলেপ দিতে হবে তাকে ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তে সাথে যুক্ত করে ক্যাথোড তড়িৎদ্বার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সিলভার ধাতুর পাত অ্যানোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ব্যাটারি দ্বারা দ্রবণে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে অ্যানোড হিসেবে যে সিলভারের পাত ব্যবহার করা হয় সেই সিলভার পাত থেকে ধাতব Ag পরমাণু একটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে Ag+ আয়নে পরিণত হয়ে দ্রবণে চলে যায় এবং দ্রবণের Ag+ আরন ক্যাথোড তড়িৎদ্বার থেকে ইলেকট্রন গ্রহণ করে ধাতব সিলভারে পরিণত হয়ে ক্যাথোডে লেগে যায়। এতে লোহার তৈরি জিনিসের উপর সিলভারের প্রলেপ পড়ে।
তড়িৎ বিশ্লেষণে উৎপাদিত পদার্থের বাণিজ্যিক ব্যবহার
তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা অনেক কিছু করতে পারি। বিভিন্ন সক্রিয় ধাতুর নিষ্কাশন থেকে শুরু করে অনেক মূল্যবান যৌগ ও মৌলের উৎপাদন, এক ধাতুর উপর অন্য ধাতুর প্রলেপ দিয়ে তার ক্ষয় রোধ করা, উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করাসহ আরও অনেক কিছু তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আকরিক থেকে বিভিন্ন ধাতু যেমন: সোডিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, দস্তা, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম প্রভৃতি নিষ্কাশন করা হয়। এছাড়া তামা, সোনা, রূপা এর বিশুদ্ধ করতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। আধুনিক বিশ্বে এসব ধাতুর ব্যবহার অপরিসীম।
আমরা জানি, রুপা ও তামার বৈদ্যুতিক রোধ সবচেয়ে কম। কিন্তু রুপার দাম অনেক বেশি। তাই বৈদ্যুতিক তার তৈরিতে তামা ব্যবহার করা হয়। তোমরা কি চিন্তা করতে পারো সারা বিশ্বে কত বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার হচ্ছে? অ্যালুমিনিয়াম অতি প্রয়োজনীয় ধাতু। এ ধাতু দিয়ে বিভিন্ন থালাবাসন তৈরি করা হয়ে থাকে। তাছাড়া অ্যালুমিনিয়াম হালকা ধাতু বলে বিমান তৈরিতে অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার করা হয়। লোহার উপর মরিচা পড়া ঠেকাতে লোহার উপর দস্তা ও ম্যাগনেসিয়ামের প্রলেপ দেওয়া হয়। এতে লোহার স্থায়িত্বও বৃদ্ধি পায়। অল্প দামী ধাতুর গয়নার উপর উজ্জ্বল ধাতু যেমন: ক্রোমিয়াম, নিকেল, সোনা, রুপা প্রভৃতি ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হয়। এতে গয়না অনেক উজ্জ্বল ও মসৃণ হয়।
সমুদ্রের পানির তড়িৎ বিশ্লেষণে উৎপন্ন ক্লোরিন জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড ক্ষার ব্যবহৃত হয়।
গ্যালভানিক কোষ বা ভোল্টায়িক কোষ (Galvanic Cell or voltaic Cell)
গ্যালভানিক বা ভোল্টায়িক কোষ হলো সেই সকল কোষ, যেখানে কোষের ভিতরের পদার্থসমূহের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা হয়। গ্যালভানিক কোষে সাধারণত দুটি ভিন্ন মৌল দিয়ে তৈরি দুটো ইলেকট্রোডকে দুটি ভিন্ন পাত্রের তড়িৎ বিশ্লেষ্যের দ্রবণের মধ্যে আংশিকভাবে ডুবানো থাকে। তড়িৎদ্বার দুইটির মধ্যে অধিক সক্রিয় ধাতুর ইলেকট্রোড অ্যানোড আর কম সক্রিয় ধাতুর ইলেকট্রোড ক্যাথোড হিসেবে কাজ করে। কোনো তড়িৎদ্বার যে ধাতু দিয়ে তৈরি সেই ধাতুর তড়িৎদ্বারকে এমন একটি তড়িৎ বিশ্লেষ্যের মধ্যে রাখতে হবে যেন তড়িৎ বিশ্লেষ্যের মধ্যে সেই ধাতুর আয়ন থাকে। যেমন— কপার ধাতুর দণ্ড দিয়ে যদি তড়িৎদ্বার তৈরি করা হয় তবে ঐ দণ্ডকে CuSO4 তড়িৎ বিশ্লেষ্যের দ্রবণে রাখা হয়। আবার, জিংক ধাতুর দণ্ড দিয়ে যদি তড়িৎদ্বার তৈরি করা হয় তবে ঐ দণ্ডকে ZnSO4 তড়িৎ বিশ্লেষ্যের দ্রবণে রাখা হয়। তড়িৎদ্বার দুটিকে বাইরে থেকে ধাতব তার দিয়ে সংযোগ করলে এক তড়িৎদ্বার থেকে অপর তড়িৎদ্বারে ইলেকট্রন প্রবাহিত হয় অর্থাৎ বিদ্যুৎ প্রবাহের সৃষ্টি হয়। দুইটি তড়িৎ বিশ্লেষ্যের দ্রবণের মধ্যে U আকৃতির লবণ সেতু স্থাপন করা হয়। U আকৃতির একটি কাচনলে KCl লবণের দ্রবণ থাকে। গ্যালভানিক কোষের অ্যানোড, ক্যাথোড়, তড়িৎদ্বারে বিক্রিয়া, লবণ সেতুর ভূমিকা এগুলো ভালোভাবে বুঝতে তোমাদের জন্য ডেনিয়েল কোষের গঠন আলোচনা করা হলো।
ডেনিয়েল কোষ (Daniell cell) জন ফ্রেডরিক ডেনিয়েল 1836 সালে এ কোষটি প্রথম আবিষ্কার করেন। তাঁর সম্মানে এ কোষকে ডেনিয়েল কোষ বলে। দুইটি কাচ বা চিনামাটির পাত্রের একটিতে জিংক সালফেট দ্রবণ এবং অপরটিতে কপার সালফেট দ্রবণ নেওয়া হয়। জিংক সালফেট দ্রবণে জিংক দণ্ড আর কপার সালফেট দ্রবণে কপারের দণ্ড প্রবেশ করানো হয়। পাত্র দুইটির দ্রবণের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য চিত্রের মতো U আকৃতির লবণ সেতু দুইটি দ্রবণের মধ্যে ডুবানো হয়। এবার একটি ধাতব তার দিয়ে তড়িৎযার দুইটি সংযোগ ঘটানো হয়। তারের মাঝে একটি বাল্ব থাকলে এবং তারের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত শুরু হলে বাল্বটি জ্বলে উঠে। এখানে জিংক তড়িৎদ্বারে জিংকের একটি পরমাণু দুইটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে জিংক আয়নে (Zn2+) পরিণত হয়। এই জিংক আয়ন তড়িৎবার ছেড়ে দ্রবণে প্রবেশ করে। ইলেকট্রন দুইটি জিংক তড়িৎদ্বার গ্রহণ করে। ফলে এ তড়িৎবার ঋণাত্মক চার্জযুক্ত হয়। এই ইলেকট্রন দুইটি তড়িৎদ্বার দুইটিকে যে তার দিয়ে সংযোগ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। যেহেতু জিংকের তড়িৎদ্বারে ধাতব Zn থেকে Zn2+ পরিণত হয়, সেহেতু বলা বার এ তড়িৎদ্বারে জারণ বিক্রিয়া ঘটে। তাই এ তড়িৎদ্বার হলো অ্যানোড।
অ্যানোডে জারণ বিক্রিয়া: Zn Zn2+ + 2e-
এবার জিংক অ্যানোড থেকে আসা ২টি ইলেকট্রন কপার তড়িৎদ্বারে প্রবেশ করে। এ তড়িৎদ্বার থেকে CuSO4 দ্রবণের Cu2+ আরন দুইটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে ধাতব কপারে (Cu) পরিণত হয়। কপার তড়িৎদ্বারে বিজ্ঞারপ ঘটেছে বলে কপার তড়িৎদ্বার ক্যাথোড তড়িৎদ্বার হিসেবে বিবেচিত।
ক্যাথোডে বিজারণ বিক্রিয়া: Cu2+ + 2e- Cu
সামগ্রিক কোষ বিক্রিয়া: Zn + Cu2+ Zn2 + +Cu
অ্যানোডে জিংক ইলেকট্রন দান করে বলে অ্যানোডে জারণ বিক্রিয়া ঘটেছে। কিন্তু শুধু ইলেকট্রন দান করলে বিক্রিয়া সম্পন্ন হয় না। এ ইলেকট্রন গ্রহণও করতে হবে। ক্যাথোড তড়িৎদ্বারে জিংকের দান করা ইলেকট্রন কপার আয়ন গ্রহণ করে বিজারণ বিক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। অর্থাৎ অ্যানোডে অর্ধেক বিক্রিয়া আর ক্যাথোডে অপর অর্ধেক বিক্রিয়া ঘটেছে।
তাই অ্যানোডের বিক্রিয়াকে জারণ অর্ধবিক্রিয়া আর ক্যাথোডের বিক্রিয়াকে বিজারণ অর্ধবিক্রিয়া বলা হয়েছে। কোষ বিক্রিয়া যেহেতু ক্যাথোডের বিক্রিয়া আর অ্যানোডের বিক্রিয়ার যোগফল, তাই কোষ বিক্রিয়া হলো জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া।
অ্যানোড থেকে ইলেকট্রন তারের মধ্য দিয়ে ক্যাথোডে প্রবেশ করে অর্থাৎ তারের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন বা বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় অর্থাৎ বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন হয়েছে। অর্থাৎ গ্যালভানিক কোষে রাসায়নিক শক্তি বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
টেবিল 8.03: তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ ও গ্যালভানিক কোষের পার্থক্য।
তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ | গ্যালভানিক কোষ |
যে কোষে তড়িৎ শক্তি ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো হয় তাকে তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ বলে। | যে কোষে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে তড়িৎ শক্তি উৎপন্ন করা হয় তাকে গ্যালভানিক কোষ বলে। |
তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষে অ্যানোড ধনাত্মক চার্জযুক্ত এবং ক্যাথোড ঋণাত্মক চার্জযুক্ত। | গ্যালভানিক কোষে অ্যানোড ঋণাত্মক চার্জযুক্ত কিন্তু ক্যাথোড ধনাত্মক চার্জযুক্ত। |
কোনো মৌল বা যৌগ উৎপাদন, ইলেকট্রোপ্লেটিং, ধাতু বিশোধন প্রভৃতি কাজে তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ ব্যবহার করা হয়। | তড়িৎ শক্তি উৎপাদন করার যন্ত্র যেমন- ব্যাটরি তৈরিতে গ্যালভানিক কোষ ব্যবহৃত হয়। |
গ্যালভানিক কোষের তড়িৎদ্বার: গ্যালভানিক কোষের নানা ধরনের তড়িৎদ্বার রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে সহজে তৈরি করা যায় ধাতু-ধাতুর আয়ন তড়িৎদ্বার। এ ধরনের তড়িৎদ্বারগুলোকে তৈরি করতে কোনো ধাতুর দণ্ড বা পাতকে সেই ধাতুর আয়নবিশিষ্ট দ্রবণে অর্ধেক বা অর্ধেকের বেশি পরিমাণে নিমজ্জিত করে তৈরি করা হয়। এ তড়িৎদ্বারকে লিখে প্রকাশ করতে হলে প্রথমে ধাতু তারপর ধাতুর আয়নকে পাশাপাশি লিখে দুটির মাঝখানে খাড়া দাগ দিতে হয়। যেমন— জিংক ধাতুর দণ্ডকে ZnSO4 এর দ্রবণের মধ্যে রাখলে জিংক ধাতুর তড়িৎদ্বার তৈরি হয়ে গেল। একে Zn|Zn2+ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এ তড়িৎদ্বারে নিম্নরূপ বিক্রিয়া ঘটে।
Zn Zn2+ + 2e-
অধিক সক্রিয় ধাতু যেমন-সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি ধাতুর তড়িৎদ্বার এভাবে তৈরি হয় না।
গ্যালভানিক কোষে অ্যানোড এবং ক্যাথোড শনাক্তকরণ
দুইটি তড়িৎদ্বার দিয়ে কোনো গ্যালভানিক কোষ তৈরি করলে কোনটি অ্যানোড এবং কোনটি ক্যাথোড হবে তা নির্ভর করে সেগুলো কোন মৌল দিয়ে তৈরি তার উপর। তড়িৎ রাসায়নিক সারির উপরের দিকে অবস্থিত অধিক সক্রিয় মৌলের তড়িৎদ্বার অ্যানোড এবং তড়িৎ অবস্থিত অপেক্ষাকৃত কম সক্রিয় মৌলের তৈরি ইলেকট্রোড ক্যাথোড হিসেবে কাজ করে। তড়িৎ রাসায়নিক সারির যেকোনো 2টি ধাতুর মধ্যে যে ধাতুটি উপরে অবস্থিত সে ধাতুর দণ্ডটি অ্যানোড এবং যে ধাতুটি নিচে অবস্থিত সে ধাতুর দণ্ডটি ক্যাথোড হিসেবে কাজ করে।
এই তড়িৎ রাসায়নিক সারি থেকে যেকোনো দুইটি ধাতুর তড়িৎদ্বার তৈরি করে ঐ তড়িৎদ্বার দুটি দিয়ে যদি গ্যালভানিক কোষ তৈরি করা হয় তবে সারিতে তুলনামূলক উপরে অবস্থিত ধাতুর তড়িৎদ্বারটি অ্যানোড আর তুলনামূলক নিচে অবস্থিত ধাতুর তড়িৎদ্বারটি ক্যাথোড হিসেবে কাজ করবে। যেমন কপার ধাতু ও সিলভার ধাতুর তড়িৎদ্বার দিয়ে গ্যালভানিক কোষ তৈরি করা হয় তবে কপার ধাতুর তড়িৎদ্বারটি অ্যানোড আর সিলভার ধাতুর তড়িৎদ্বারটি ক্যাথোড হিসেবে কাজ করবে। যেহেতু তড়িৎ রাসায়নিক সারিতে কপার ধাতুর অবস্থান উপরে আর সিলভার ধাতুর অবস্থান নিচে। এই কোষে কপার পরমাণু ইলেকট্রন ত্যাগ করে কপার আয়নে পরিণত হয়।
লবণ সেতু ও তার ব্যবহার
তোমরা ডেনিয়েল কোষে দেখেছো অ্যানোডে ধাতব জিংক দুইটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে জিংক আয়নে পরিণত হয়। এ ইলেকট্রন বাইরের তার দিয়ে ক্যাথোডে যায়। ফলে অ্যানোডের দ্রবণে ধনাত্মক আয়ন বেশি হয়ে যায়।
অ্যানোডে জারণ অর্ধবিক্রিয়া: Zn+ Zn2+ + 2e
আবার, ক্যাথোডে থাকা CuSO4 এর দ্রবণ থেকে Cu2+ আয়ন দুইটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে আধান নিরপেক্ষ Cu পরমাণুতে পরিণত হয় কিন্তু So42- আয়নের কোনো পরিবর্তন হয় না। ফলে প্রবণ ঋণাত্মক আধান প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ দুইটি দ্রবণের আধান নিরপেক্ষতা নষ্ট হয়। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যে বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এই বিক্রিয়া চালু রাখার জন্য লবণ সেতু ব্যবহার করা হয়। একটি U আকৃতির কাচের নদের মধ্যে আগার আগার নামের একটি রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে KCl লবণের প্রবণ মেশানো হয়। ফলে জেলির মতো মিশ্রণ তৈরি হয়। একে লবণ সেতু বলে। এই লবণ সেতুতে বিদ্যমান K+ আয়ন ও Cl- আয়ন এর গতি সমান । KCl দ্রবণ দিয়ে তৈরি লবণ সেতুর দুই মুখে তুলা দিয়ে চিত্রের মতো পরোক্ষভাবে দুইটি তড়িৎ বিশ্লেষ্যের দ্রবণকে সংযোগ দেওয়া হয়।
এখন অ্যানোডের দ্রবণে যতগুলো ধনাত্মক চার্জ বেশি হয় লবণ সেতু থেকে ততগুলো Cl- জায়ন অ্যানোড দ্রবণে চলে আসে। জাবার ক্যাথোডের দ্রবণে যতগুলো ধনাত্মক চার্জ কমে যার লবণ সেতু থেকে ততগুলো K+ আরন ক্যাথোড দ্রবণে চলে আসে। ফলে অ্যানোড ও ক্যাথোড উভয় দ্রবণের তড়িৎ নিরপেক্ষতা বজায় থাকে। ফলে কোষের তড়িৎ প্রবাহ নির্বিঘ্নে চলতে থাকে।
ড্রাই সেল
ড্রাই সেল (কোষ) এক ধরনের গ্যালভানিক কোষ। ড্রাই সেলের মাধ্যমে রাসায়নিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। আমরা সাধারণত টর্চলাইট জ্বালাতে, রেডিও বাজাতে, টিভির রিমোট চালাতে, খেলনা চালাতে ড্রাই সেল ব্যবহার করি। ড্রাই সেলও অ্যানোড এবং ক্যাথোড দ্বারা গঠিত।
ড্রাই সেলের অ্যানোড ও ক্যাথোড প্রান্তকে যদি বাল্ব বা কোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্রের দুই প্রান্তে যুক্ত করা হয় তখন ইলেকট্রনের প্রবাহ সৃষ্টি হয় অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। তাহলে যেখানে বিদ্যুৎ প্রয়োজন সেখানে ড্রাই সেন সংযুক্ত করলেই উল্লিখিত বিক্রিয়াসমূহ সংঘটিত হবে এবং আমরা বিদ্যুৎ শন্তি পাব।
তড়িৎ রাসায়নিক কোষের প্রয়োগ
প্রাচীনকাল থেকেই তড়িৎ বিশ্লেষণ কৌশল ব্যবহার করে এক ধাতুর উপর অন্য ধাতুর প্রলেপ ব্যবহার করা হতো। তবে এখন তড়িৎ বিশ্লেষণ কৌশলের ব্যবহার আরও ব্যাপক। তড়িৎ বিশ্লেষণের সাহায্যে আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশন, মূল্যবান রাসায়নিক পদার্থের উৎপাদন, বিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদন, পদার্থের বিশুদ্ধকরণ ইত্যাদি করা হয়। হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এতে অ্যানোডে হাইড্রোজেন অণু জারিত হয় আর ক্যাথোডে অক্সিজেন অণু বিজারিত হয়ে পানি উৎপাদন করে। ফলে কোষে ইলেকট্রন অ্যানোড হতে ক্যাথোডে ইলেকট্রন প্রবাহিত হয়। এই বিদ্যুতের সাহায্যে গাড়ি পর্যন্ত চলতে পারে। সারা পৃথিবীতে কতো মোবাইল ফোন, কতো কম্পিউটার, কতো ক্যালকুলেটর ব্যবহৃত হচ্ছে চিন্তা করতে পারছো, সব ক্ষেত্রে ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়।
ডায়াবেটিক রোগীর রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য তড়িৎ বিশ্লেষণ কৌশলনির্ভর সেন্সর ব্যবহার করা হয়। চিত্রে তড়িৎ বিশ্লেষণ কৌশল ব্যবহার করে মানবদেহের রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ নির্ণয় দেখানো হলো। বাম হাতের আঙুলে লাগানো ছোট অংশটিতে পাতলা ও চিকন অ্যানোড ও ক্যাথোড লাগানো আছে। অ্যানোড ও ক্যাথোডের মাঝখানে একটা ছোট ফাঁকা নালি (channel ) থাকে। যদি অ্যানোড ও ক্যাথোডের মাঝখানে ফাঁকা নালিতে রক্ত দেওয়া হয়, তাহলে একটি পুর্ণ তড়িৎ কোষ গঠিত হবে। আসলে, ফাঁকা নালিতে রক্ত দিলে কোবে সংযুক্ত উৎস হতে বিদ্যুৎ প্রবাহের ফলে রাষ্ট্র অবস্থিত গ্লুকোজ অণু অ্যানোডে জারিত হয়। অন্যদিকে, হিসাব-নিকাশ করার যন্ত্রের সাহায্যে গ্লুকোজের জারণের ফলে উদ্ভূত ইলেকট্রনের সংখ্যা নির্ণয় করে যন্ত্রটি তার পর্দায় (screen) রক্তে অবস্থিত গ্লুকোজের পরিমাণ মনিটরে ডিজিটের (digit) সাহায্যে প্রকাশ করে। মজার ব্যাপার হলো এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নির্ণয় করতে এক মিনিট বা তার কম সময় লাগে ।
স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর ব্যাটারির প্রভাব
আমরা বিভিন্ন কাজে ব্যাটারি ব্যবহার করি। ড্রাই সেল (dry cell) টর্চলাইট জ্বালানোর কাজে, লেড- স্টোরেজ ব্যাটারি (lead storage battery) বাস, ট্রাক ইত্যাদির ব্যাটারি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব ব্যাটারিতে বিভিন্ন ধাতু এবং ধাতব আয়ন ব্যবহার করা হয়। যা আমাদের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ড্রাই সেলে দস্তা (Zn) ও ম্যাঙ্গানিজ ডাই-অক্সাইড (MnO2) থাকে, লেড স্টোরেজ ব্যাটারিতে সিসা (Pb) ও সিসার অক্সাইড (PbO2 ) ইত্যাদি থাকে। রাসায়নিক ধর্মের বিবেচনায় এগুলো বিষাক্ত (toxic) ও ক্যানসার সৃষ্টিকারী (carcinogenic)। এগুলো ব্যবহারের পর আমরা যেখানে সেখানে ফেলে দেই। ফলে এ সকল বিষাক্ত পদার্থ মাটি ও পানির সাথে মিশে মাটি ও পানিকে দূষিত করে তোলে।
নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া
যে বিক্রিয়ায় কোনো মৌলের নিউক্লিয়াসের পরিবর্তন ঘটে তাকে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া বলে। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরমাণুর বা আয়নের সর্ববহিস্থ শক্তিস্তর থেকে ইলেকট্রনের আদান-প্রদান ঘটে। কিন্তু নিউক্লিয়াসের কোনো পরিবর্তন হয় না। কিন্তু নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় পরমাণুর নিউক্লিয়াসের পরিবর্তন ঘটে। এখানে ইলেকট্রনের কোনো ভূমিকা নেই। এ বিক্রিয়ার ফলে নতুন মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াসের সৃষ্টি হয়। যে বিক্রিয়ার ফলে ছোট ছোট মৌলের নিউক্লিয়াস একত্র হয়ে বড় মৌলের নিউক্লিয়াস অথবা কোনো বড় মৌলের নিউক্লিয়াস ভেঙে একাধিক ছোট মৌলের নিউক্লিয়াস তৈরি হয় সেই বিক্রিয়াকে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া বলে। নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয়।
বিভিন্ন রকমের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া আছে; তবে এদের মধ্যে নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া ও নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া অন্যতম ।
নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া
যে নিউক্লিয়ার প্রক্রিয়ায় কোনো বড় এবং ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস ভেঙে ছোট ছোট মৌলের নিউক্লিয়াসে পরিণত হয় তাকে নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া বলে। এর সাথে নিউট্রন আর প্রচুর (Fission) পরিমাপে শক্তি উৎপন্ন হয়।
নিউক্লিয়ার চেইন বিক্রিয়া
নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়াগুলোই মূলত নিউক্লিয়ার চেইন বিক্রিয়া (Chain Reaction)। যে বিক্রিয়া একবার শুরু হলে তাকে চালু রাখার জন্য অতিরিক্ত কোনো শক্তির প্রয়োজন হয় না তাকে নিউক্লিয়ার চেইন বিক্রিয়া বলে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন
বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারমাণবিক চুল্লি ব্যবহার করা হয়। নিউক্লিয় ফিশন বিক্রিয়ার সমর যে চেইন বিক্রিয়া হয়, সেই চেইন বিক্রিয়াকে যে যন্ত্রের সাহায্যে নিরন্ত্রণ করা হয় তাকে পারমাণবিক চুল্লি বলে। পারমাণবিক চুল্লির সাহায্যে প্রচুর শক্তি উৎপাদন করা যায়। পারমাণবিক চুল্লির ভিতরে ফিশন বিক্রিয়ার ফলে যে সকল ক্ষুদ্র মৌল তৈরি হয় সেগুলো উচ্চ গতিসম্পন্ন হয়। এই উচ্চ গতিসম্পন্ন ক্ষুদ্র মৌলগুলো চুল্লির ভিতরে একে অন্যের সাথে এবং দেয়ালে প্রচন্ড জোরে আঘাত করে ও প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন করে। এই তাপ চুল্লি থেকে বের করে নিয়ে এসে সেই তাপ বাষ্প উৎপাদন প্রকোষ্ঠে চালনা করা হয়। এই তাপ দিয়ে বাষ্প উৎপাদন করা হয়। এখন ঐ বাষ্পের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য টারবাইন চালনা করা হয়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পারমাণবিক চুল্লির ভেতরেই বাল উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকে। পৃথিবীর অনেক দেশে পারমাণবিক চুল্লির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার পাবনা জেলার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।